দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় দুদকই কি যথেষ্ট?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার ধারণায় এ উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ অপচয় হয়ে থাকে। এর অর্থ হলো, বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে প্রতি বছর আমাদের দেশের অপচয়জনিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। আর একটি তথ্য এখানে দেয়া অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে যে, ঋণ ও সাহায্য মিলিয়ে বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হবে না। মোদ্দা কথা হলো, শুধু উন্নয়ন খাতে দুর্নীতি রোধ করা গেলে আমাদের আর তথাকথিত দাতা অথবা উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হতো না। ফলে বিদেশি কূটনীতিকরা প্রতি পদে পদে এবং প্রকাশ্যে আমাদের পবিত্র মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখাতেও আর সক্ষম হতেন না।

এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে দুটি প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রথম প্রশ্নটি হলো, এ দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করা আদৌ সম্ভব কি না। দ্বিতীয়টি হলো, প্রথম প্রশ্নের জবাব ইতিবাচক হলে গত পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যর্থতা দূর করার জন্য আমরা কী পদ্ধতি গ্রহণ করব। আমি বরাবরই বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ এবং সে মানসিকতার ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করি যে, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ করা অবশ্যই সম্ভব। এবার দেখা যাক সে উদ্দেশ্য পূরণের কৌশলটি কী হতে পারে। সাধারণভাবে সরকারি কার্যক্রমসংশ্লিষ্ট দুর্নীতির দুষ্টচক্রের তিন সহযোগী হচ্ছে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী। আমাদের দেশে সরকারি খাতে দুর্নীতির বেশিরভাগ সংঘটিত হয় সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত সরকারি নীতি প্রণয়নে। এর মধ্যে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমের দুর্নীতিতে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রধান দুটি দল হচ্ছে আমলা ও ব্যবসায়ীরা।

দুর্নীতির বাকি দুটি ক্ষেত্র অর্থাত্ ক্রয়-বিক্রয় এবং নীতি প্রণয়নবিষয়ক দুর্নীতিতে অবশ্য রাজনীতিবিদরা সচরাচর প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমলা ও ব্যবসায়ীরা থাকেন সক্রিয় সহযোগীর ভূমিকায়।

দেশে নব্বইয়ের দশকে পুরোপুরি মুক্তবাণিজ্য শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত অবশ্য ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য লাইসেন্স প্রদান বিষয়ক আরেক শ্রেণীর দুর্নীতির সুযোগ গ্রহণ করতেন তত্কালীন শাসকরা। এ জাতীয় বিখ্যাত একটি দুর্নীতির উদাহরণ হচ্ছে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলের শেষ সময়ের বহুল আলোচিত চিনি বিষয়ক দুর্নীতি। স্মরণ আছে, তখনকার এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নামের আগে ‘চিনি’ শব্দটি সহজবোধ্য কারণে বিশেষণের মতা ব্যবহৃত হতো। সরকারি খাতে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির কিছু বহুল আলোচিত উদাহরণের মধ্যে রয়েছে এরশাদ আমলের কাফকো (KAFCO) ও জাপানি বোট ক্রয়, শেখ হাসিনার আমলের মিগ-২৯ ও ফ্রিগেট ক্রয়, অতিসাম্প্রতিককালে জোট সরকারের সময়ে সিএনজি বেবিট্যাক্সি ও আরইবি’র (REB) জন্য কংক্রিট পোল (Concrete pole) ক্রয় ইত্যাদি। দুর্নীতির আরো একটি বড় সুযোগ হলো সরবরাহকারীর ঋণের (supplier’s credit) মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্পে আবার আমাদের তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলো সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকে। এ শ্রেণীর দুর্নীতিযুক্ত প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কাফকো, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, মধ্যপাড়া কঠিনশিলা, ডিএপি-১, ডিএপি-২সহ বেশকিছু বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রকল্প। ২০০১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সঙ্গত কারণেই সরকারের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটকে নিরুত্সাহিত করলেও অজ্ঞাত কারণে পরবর্তী সময়ে এ জাতীয় বেশকিছু প্রকল্প অনুমোদন করেন।

সরকারি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে দুর্নীতির একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে নাইকোর কাহিনী বর্ণনাই যথেষ্ট হবে বলে আমি মনে করি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের দ্বারা প্রণীত দুর্নীতির এমন একটি উপাখ্যান সম্পর্কে অবহিত হওয়া জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যে কোনো নতুন মন্ত্রী, উপদেষ্টা অথবা সচিবের ওরিয়েন্টেশনের অংশ হওয়া উচিত। এ উপাখ্যানের শুরু ১৯৯৮ সালের ২৮ জুন যখন তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার ছাতক, কামতা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবজার গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য নাইকোর একটি অযাচিত (unsolicited) প্রস্তাব গ্রহণ করে তখন। সে অযাচিত প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে উল্লিখিত গ্যাসক্ষেত্রগুলোকে প্রান্তিক ও পরিত্যক্ত (marginal) বিবেচনা করে নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের সমঝোতা স্মারকের প্রস্তাব তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ২০ মে অনুমোদন করেন। এ সমঝোতা স্মারকের প্রধান অনুঘটক ছিলেন তত্কালীন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম। তারই ১৬-৫-৯৯ তারিখের প্রস্তাবের ওপর ওই বিভাগের প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে একই দিনে সারসংক্ষেপে স্বাক্ষর করেন। বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ প্রস্তাবের অনুমোদনের বিষয়টি আগেই বর্ণিত হয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধান এবং ২০০৬ সালে কর্মচ্যুত কাশেম শরীফ সাবেক সচিব ড. তৌফিকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে মন্ত্রণালয়ে বিশেষ পরিচিত।

যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন অনুযায়ী ২৩ আগস্ট ১৯৯৯ সালে ওপরে বর্ণিত সমঝোতা স্মারক সই হলো। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের একেবারে শেষদিকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সম্ভবত স্মরণে এলো যে কোনো গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক অথবা পরিত্যক্ত ঘোষণা করার জন্য দেশে কোনো নীতিমালাই নেই। সে হিসেবে নাইকোর সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আইনগত বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্ভবত এ বিবেচনা থেকে দ্রুততার সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি পদ্ধতির খসড়া তৈরি করা হলো। কিন্তু সমস্যা তো অন্যখানে। প্রশ্ন থেকে যাবে যে, প্রান্তিক বা পরিত্যক্ত ঘোষণার কোনো পদ্ধতি ছাড়াই সরকার তাহলে কোন আইনে ১৯৯৯ সালে ছাতক, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রগুলোকে পরিত্যক্ত বিবেচনা করে নাইকোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। সমাধানটি বেশ চিত্তাকর্ষক। পদ্ধতির খসড়ায় একটি নতুন ধারা সংযুক্ত হলো, ধারাটি নিম্নরূপ :
‘10. Explanatory note : For the purposes of these procedures, Chhatak, Kamta and Feni Gas fields shall be deemed to have been declared marginalabandoned gas fields, and the negotiations/discussions conducted so far with the approval accorded by the government in 1999, shall be deemed to have been in compliance with the above procedures.’
অর্থাত্ পদ্ধতিটি যখনই রচিত হোক না কেন, ধরে নিতে হবে যে, ছাতক, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র ইতোমধ্যেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ধরনের সাহসিকতাপূর্ণ দুর্নীতির জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে বাহবা দিতেই হয়। খসড়া অনুযায়ী তত্কালীন সচিব এম আকমল হোসেইন প্রস্তাব তৈরি করলেন ২০০১ সালের ৬ জুন। একই প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম কালবিলম্ব না করে একই দিন ‘সারসংক্ষেপে’ স্বাক্ষর কররেন। বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুন ২০০১ সালে প্রস্তাব অনুমোদন করলেন অর্থাত্ ছাতক, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। পাঠকরা হয়তো অবাক বিস্ময়ে ভাবছেন, কত সহজেই না আইন বদলায়, দেশের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়।

২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে পরাজিত হলো। বেগম খালেদা জিয়া জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন। নতুন সরকার। নতুন আশা। কিন্তু ছাতক আর ফেনী গ্যাসক্ষেত্রের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং আওয়ামী লীগ আমলে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যে যৌথ প্রকল্প চুক্তি (Joint Venture Agreement) স্বাক্ষরিত হলো। এর পরের ইতিহাস পাঠকরা মোটামুটি জানেন। শুধু দুটি তথ্য এখানে আপনাদের অবগতির জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

২০০৫ সালের ২০ জুন থেকে ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর এই স্বল্পসময়ে জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে নাইকোর কাছ থেকে গ্যাসের ক্রয়মূল্য প্রতি MCF-এ ০.৩৫ মার্কিন ডলার কমিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সমর্থ হয়েছিলাম। আর এ সময়কালে নাইকোকে তার গ্যাসের মূল্য বাবদ একটি ডলারও প্রদান করা হয়নি। এর ফলে টেংরাটিলার দুই দফা ব্লো-আউটজনিত ক্ষতিপূরণ আদায় করার একটি বাস্তবসম্মত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি, বর্তমান সরকার এ সুযোগটি কাজে লাগাবেন।

এতক্ষণে পাঠকরা হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন যে, শুধুই তো দুর্নীতির প্রকারভেদ এবং ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। দুর্নীতি দূর করার কৌশল কোথায়? প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি কারা করছেন, কেমন করে করছেন, কোন খাতে করছেন-এসব চিহ্নিতকরণ দুর্নীতি নির্মূল কার্যক্রমেরই পূর্বশর্ত। এ কারণেই উপরিউক্তি বিষয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এবার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নির্মাণ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। এ বিষয়েও চিন্তার ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। যেমন অনেকে দুর্নীতি নির্মূলের জন্য শাস্তির ওপরই অধিকতর আস্থাশীল। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার, এ প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ এবং দুদকে সত্ ও দক্ষ কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান করলেই দেশ থেকে মোটামুটি দুর্নীতি নির্মূল হয়ে যাবে বলে টিআইবি’র মতো সমাজের একটি বড় অংশই বিশ্বাস করেন।

এ সম্পর্কে আমার ধারণা ভিন্নতর। দুদক যখন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল, তখন সেখানেও অনেক সত্ ও দক্ষ ব্যক্তি কর্মরত ছিলেন। এ ধরনের তিনজন ব্যক্তিকে তো আমিই ব্যক্তিগতভাবে জানি। প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন বর্তমান যোগাযোগ উপদেষ্টা, যিনি ২০০১ থেকে দীর্ঘ তিন বছর দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক ছিলেন। সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান এবং ট্যাক্স ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম এম আই খানও দুর্নীতি দমন ব্যুরোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছিলেন। এ তিনজনই অত্যন্ত সত্ ও দক্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে সমাজে পরিচিত এবং প্রশংসিত। তারা নিজেরা অত্যন্ত সত্ হয়েও কিন্তু প্রশাসন থেকে দুর্নীতি দূর করতে সক্ষম হননি। বরং টিআইবি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ দুর্নীতিতে একাদিক্রমে পাঁচ বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

বাংলাদেশের ৩৫ বছরের ইতিহাসে বর্তমান সরকার এখন সবচেয়ে কঠোর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু অভিযান চলাকালীনও আমরা জানতে পারছি যে, পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ঘুষ গ্রহণ করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ছে। অর্থাত্ এত কঠোর অভিযানও দুর্নীতিবাজদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। এর অর্থ হচ্ছে শুধু কোনো খণ্ডিত কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব না। এ বাস্তবতাকে প্রথমে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। তার সঙ্গে এটিও স্বীকার করতে হবে যে, শুধু স্বাধীন দুদক প্রতিষ্ঠা করলেই আমরা শুদ্ধ নাগরিক হয়ে যাব না। আমি মনে করি, স্বাধীন দুদক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বিত কার্যক্রমের একটি অংশমাত্র।

এরশাদ আমলের পর সম্ভবত গত বিএনপি সরকারই দুর্নীতির অভিযোগে সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। এরকম একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর বিনিয়োগ বোর্ড এবং সরকারের শেষ ১৬ মাস জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ পরিচালনাকালে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা সম্ভব হয়েছিল। সে লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আমার বিবেচনায় দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চারটি কর্মসূচিকে সমন্বয় করে একযোগে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, সত্ কর্মকর্তাদের স্বীকৃতি প্রদান ও পুরস্কৃত করা, দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সূচনা এবং দুর্নীতিবিরোধী কঠোর ও পক্ষপাতহীন অভিযান পরিচালনা। বর্তমানে শেষোক্ত কর্মসূচিটি জোরেশোরে চললেও প্রথম তিনটি কৌশল নিয়ে কোনো কার্যক্রম তো দূরের কথা, এ প্রসঙ্গে আমরা আলোচনাও শুরু করিনি।
সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। একটি ছোট উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের দরপত্রগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ শুরু করলে স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত হবে, সেই সঙ্গে চাঁদাবাজি, ঘুষ গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগও বহুলাংশে কমে যাবে। সরকারি বৃহত্ ক্রয়চুক্তির জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের জন্য এ সংক্রান্ত আলোচনা সংসদে হতে পারে। যাতে বিরোধী দলও এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের মতামত জানানোর সুযোগ পায়। অবশ্য তার আগে সংসদ বর্জনের কুপ্রথা নিষিদ্ধ করে সংসদকে অবশ্যই অর্থবহ করতে হবে।

সরকারি দায়িত্ব পালনকালে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বর্তমান পদ্ধতিতে সত্ কর্মকর্তার কোনো রকম স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন একেবারেই অনুপস্থিত। সততার জন্য সরকারি ব্যবস্থায় কোনো প্রণোদনাই (incentive) বর্তমানে নেই। এরকম পরিবেশেও যারা সত্ থাকছেন, তারা শুধু নিজের বিবেকের তাড়নাতেই সত্ জীবনযাপন করছেন। এ ধরনের কর্মকর্তার সংখ্যা কম এবং স্বাভাবিক জাগতিক নিয়মেই ক্রমাগত আরও কমে আসছে। অথচ ভেবে দেখুন, সততার জন্য যদি দ্রুত পদোন্নতি দেয়ার রেওয়াজ থাকতো কিংবা সরকারি বাসা বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে সত্ কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকারের বিধান থাকতো, অথবা নিদেনপক্ষে বছরে একবার সরকারপ্রধান সত্ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিশেষভাবে সম্মানিত করতেন, তাহলে আমরা কি প্রশাসনের এতটা অধোগতি দেখতাম? সরকার যারা পরিচালনা করেন, তাদের এত চিন্তা করার সময় কোথায়? তারা আত্মউন্নয়নের কাজেই সর্বদা ব্যস্ত।

এবার সামাজিক আন্দোলন প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার বাল্যকালে অর্থাত্ ষাটের দশকে আমি পুরনো ঢাকায় থাকতাম। এলাকায় জনশ্রুতি ছিল যে, আমাদের প্রতিবেশী এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রচুর দুর্নীতিলব্ধ ধন-সম্পদ ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তার স্ত্রীকে কখনো কেউ তখনকার সময়ে ১০-১২ টাকার চেয়ে বেশি দামের শাড়ি পরতে দেখেনি, যদিও অনেক উচ্চমূল্যে শাড়ি কেনার ক্ষমতা ওই মহিলার ছিল। কারণ আর কিছুই না, পাছে লোকে কিছু বলে। তুলনা করুন তো এখনকার সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে। দুর্নীতিলব্ধ ঐশ্বর্য প্রদর্শনের কদর্যতম প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এ মানসিকতা পরিবর্তন করবেন কেমন করে? আর মানসিকতা পরিবর্তন ছাড়া দুর্নীতি নির্মূলের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। কাজেই বর্তমানে যে অভিযান চলছে তার সঙ্গে এ নিবন্ধে প্রস্তাবিত তিনটি কর্মসূচি সমন্বয় করার জন্য বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রস্তাব রাখছি। নইলে আমি নিশ্চিত যে, দুর্নীতি নির্মূলের বর্তমান উত্সাহ খুব বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। একটি পত্র উদ্ধৃত করে এ নিবন্ধ শেষ করব। জোট সরকারের একেবারে শেষলগ্নে বিনিয়োগ বোর্ডের তত্কালীন নির্বাহী চেয়ারম্যানের লিখিত এ আধা-সরকারি পত্রটি। পাঠক সহজেই বুঝবেন যে, কেন এ পত্রটি আজকের নিবন্ধে অতি প্রাসঙ্গিক।

‘‘প্রিয় মুখ্য সচিব,
আমার সালাম গ্রহণ করুন।
বিগত পাঁচ বছরের সরকারের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে সুশাসন (Good Governance) সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ খুব সংক্ষিপ্ত আকারে আপনার এবং আপনার উত্তরসূরিদের কাজে সহায়তার জন্য লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। সরকারি দায়িত্ব পালনকালে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, প্রচলিত ব্যবস্থায় বা সরকারি রীতিনীতিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় Incentive একেবারেই অনুপস্থিত।

বর্তমান সরকারের শাসনামলে আমার সর্বস্তরের সহকর্মীদের সহযোগিতায় বিনিয়োগ বোর্ডকে একটি দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। এটি বোধহয় দাবি করা অসঙ্গত হবে না যে, বিনিয়োগ বোর্ড আজকের বাস্তবতায় দেশের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা কোনোরকম তথাকথিত Speed money ব্যতিরেকেই বিনিয়োগ বোর্ড থেকে প্রয়োজনীয় সেবা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পাচ্ছেন। ফলে বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমান সরকার আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি জাপানের একটি বিখ্যাত Corporate Bank প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা আপনার অবগতির জন্য সংযুক্ত করলাম (সংযুক্তি-১)। এ প্রতিবেদনে বিনিয়োগ বোর্ডকে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি দৃষ্টান্তরূপে অভিহিত করা হয়েছে। UNCTAD-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের স্থান (১১৬), ভারতের স্থান (১১৯) প্রথমবারের মতো অতিক্রম করেছে।

উপরোক্ত অর্জনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়নি। এর জন্য আমার প্রতিটি সহকর্মীকে অত্যন্ত অপ্রতুল সরকারি বেতনে সততার সঙ্গে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে। অত্যন্ত মর্মবেদনার সঙ্গে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, এ দৃষ্টান্তমূলক কাজের বিনিময়ে Incentive তো নয়ই, এমনকি তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাদিও আমি প্রদান করতে সক্ষম হইনি। দৃষ্টান্তস্বরূপ আপনার কাছে প্রেরিত ২৭-০৪-২০০৩ এবং ০৮-০৪-২০০৪ তারিখের পত্রের (সংযুক্তি-২) প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যেখানে বিনিয়োগ বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কয়েকটি অতিরিক্ত সরকারি বাসা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আপনার এবং তত্কালীন পূর্ত সচিবকেও আমি একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছি। বলাই বাহুল্য, সে বাসা অদ্যাবধি বরাদ্দ হয়নি।

দ্বিতীয় উদাহরণ, দীর্ঘ পাঁচ বছর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিনিয়োগ বোর্ডের সাংগঠনিক কাঠামো সরকার কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ বিষয়ে আপনাকে ২টি সরকারি/আধা সরকারি পত্র (সংযুক্তি-৩) এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনটি সারসংক্ষেপ প্রেরণ করা হয়েছে (সংযুক্তি-৪)। সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদন না হওয়ার ফলে বিনিয়োগ বোর্ডে একই পদে একজন কর্মকর্তা দীর্ঘ ১৭ বছরেরও অধিককাল ধরে কর্মরত আছেন। এ অবস্থায় সরকার কীভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে সততা অথবা সুশাসন আশা করতে পারে এটিই আমার জিজ্ঞাস্য।

ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনায় আপনার কোনো সুযোগ হলে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য আশা করি এমন সংস্কার করবেন যাতে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রে সততার সঙ্গে কাজ করার একটি পরিবেশ তৈরি হয়। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে সত্, দক্ষ এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়-এ ধারণার সঙ্গে আপনি নিশ্চয়ই সহমত পোষণ করবেন।
ধন্যবাদান্তে, একান্তভাবে আপনার মাহমুদুর রহমান।”

দ্রষ্টব্য : নিবন্ধটি ২০০৭ সালে লেখা : মাহমুদুর রহমানের লেখা ‘জাতির পিতা ও অন্যান্য’ বই থেকে আমারদেশ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রণ করা অংশ হতে সংগ্রহ করা হলো।

দল মত নির্বিশেষে একটি সাহসি চিন্তা চিন্তাশীল পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য এ লেখাটি সংগৃহীত।