এবিএম মুসাঃ সংকলন - ২

প্রীতি ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবিএম মূসাকে
সিরাজুর রহমান
১২ এপ্রিল ২০১৪, শনিবার
এবিএম মূসার প্রয়াণে শোকসন্তপ্ত বহু সাংবাদিক ও গুণগ্রাহী শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সেটাই আশা করা গিয়েছিল। ছয় দশক ধরে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলাদেশ এবং তার পূর্বসূরি পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় তার অবদান ব্যাপক। সে সাথে এ দেশে সাংবাদিকতার মান বৃদ্ধি এবং সাংবাদিক পেশার উন্নয়নে তার ভূমিকা ভুলবার নয়। মূসার সাথে আমার বন্ধুত্ব প্রায় আমাদের সাংবাদিক জীবনের মতোই পুরনো। আর সবার সাথে আমিও একজন কঠোর পরিশ্রমী ও ত্যাগী সাংবাদিকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই।
এবিএম মূসার সাথে আমার প্রথম পরিচয় পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। আমি তখন দৈনিক ইনসাফের বার্তা সম্পাদক এবং মূসা পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সাব-এডিটর। ১৯৫১ সালের শেষে আমি ইনসাফ ছেড়ে প্রকাশিতব্য দৈনিক মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হই। তার অল্প কালের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার অবজারভার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। এ পত্রিকা পাকিস্তানের সংবিধান রচনা এবং নতুন স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ত্বরান্বিত করার জন্য জোরালো আন্দোলন করে যাচ্ছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠলে পাকিস্তান অবজারভার সে আন্দোলনকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। সেই সময় দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংবাদ মুসলিম লীগ সরকারের মুখপত্র ছিল। ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ তো বলতে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্বার্থের ধ্বজাধারী ছিল। পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সাহসী সমালোচনা পাকিস্তান সরকারের পাঁজরে কাঁটার মতোই ছিল।
অত্যন্ত প্রগতিশীল ও পশ্চিমী উদার গণতন্ত্রের নির্ভীক সৈনিক ছিলেন সম্পাদক আবদুস সালাম। এক তাত্ত্বিক নিবন্ধে তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছিলেন যে তৃতীয় খলিফা হজরত ওমরের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত আধুনিক গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। পরদিন দেখা গেল পাঁচ-ছয়জন লোক জনসন রোডে অবজারভার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করছে। এদের কাউকে এ পত্রিকার পাঠক বলে মনে হচ্ছিল না। অর্থাৎ তারা ভাড়া করা বিক্ষোভকারী মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু কালবিলম্ব না করেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ করার কারণ দর্শিয়ে পাকিস্তান সরকার পত্রিকাটির প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেয় এবং আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে।
আবদুস সালাম কোনো মতে মূসার বেকার হওয়ার খবরটি মিল্লাত সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বেরকে জানান। আমরা মূসাকে চট্টগ্রাম নগরীতে দৈনিক মিল্লাতের স্টাফ রিপোর্টার নিয়োগ করি। মূসা এই প্রথমবার আমার সহকর্মী হলেন। এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিকতায় নতুন একটা নজির সৃষ্টি হলো। তার আগে পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কোনো পত্রিকার বৈতনিক সংবাদদাতা ছিলেন না। সেসব সংবাদদাতা ‘মফস্বল সংবাদদাতা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাদের প্রতীক হিসেবে পত্রিকার নামছাপা নিউজপ্রিন্টের প্যাড এবং ডাক খরচ ইত্যাদি বাবদ সামান্য কিছু ভাতা দেয়া হতো। কিন্তু এবিএম মূসা ঢাকায় কর্মরত স্টাফ রিপোর্টারদের সমান বেতনে চাটগাঁয় মিল্লাতের সংবাদদাতা হলেন। স্বাভাবিক কারণেই তার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো।

মূসা দ্বিতীয়বার আমার সহকর্মী হলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকাতেই। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিরাট জয় হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকার অবিলম্বে অবজারভারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আমি তখন ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের সম্পাদক। আবদুস সালাম সাহেবের টেলিফোন পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। তিনি আবার পত্রিকাটি প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে বার্তা সম্পাদক পদে তিনি মাহবুব জামাল জাহেদীকে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু জাহেদী তখন করাচিতে পাকিস্তান সরকারের ইনফরমেশন অফিসার। ছয় মাসের নোটিশ দিয়ে তাকে চাকরি ছাড়তে হবে। এই ছয় মাস আমাকে খণ্ডকালীন ভাবে পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হতে হবে।
বিআইএসের চাকরির শর্তানুযায়ী আমি অন্যত্র কোনো চাকরি করতে পারি না। সালাম ভাইকে সে কথা জানালাম। ঘণ্টাখানেক পর তিনি আবার ফোন করলেন। ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার জর্জ ডেভিকে ফোন করে তিনি আমার জন্য অনুমতি সংগ্রহ করেছেন। তবে এ শর্তে যে অবজারভারে আমি কাগজে কলমে একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করব। সালাম ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে স্থির হলো যে আমি আমার নামের দুটো আদ্যাক্ষর এবং দাদার আমলে পরিত্যক্ত বংশগত পদবি ব্যবহার করে এস আর ভূঁইয়া নামে পাকিস্তান অবজারভারে কাজ করব।
এ পর্বে এবিএম মূসার দৃঢ়তা ও সাহসিকতার একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করলেই নয়। পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী প্রায়ই তার রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে দীর্ঘ উপসম্পাদকীয় লিখতেন তার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। এক দিন অফিসের পিয়ন তার একটা রচনা এনে মূসার হাতে দিলো প্রকাশের জন্য। লেখাটিতে চোখ বুলিয়ে তার গুণাগুণ সম্বন্ধে অত্যন্ত বিরূপ একটা মন্তব্য করেছিলেন মূসা। তার দুর্ভাগ্য, ঠিক সে মুহূর্তেই হামিদুল হক চৌধুরী এসে নিউজরুমে ঢুকলেন। সেই দিনই এবিএম মূসাকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু সম্পাদক সালাম ভাই তাকে ছদ্মনামে ক্রীড়া সংবাদদাতা নিয়োগ করেন। সন্ধ্যায় মূসা তার রিপোর্ট দারোয়নের হাতে দিয়ে যেতেন। দারোয়ান সেটা এনে নিউজরুমে দিয়ে যেত। কয়েক মাস পর হামিদুল হক চৌধুরীর রাগ পড়ে যায়। তিনি মূসাকে নিউজরুমে ফিরিয়ে নিতে রাজি হন।
মূসা আমার তৃতীয় দফা সহকর্মী হলেন বিবিসিতে। আমি ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে বিবিসি বাংলা বিভাগে যোগ দেই। তার পর থেকে তিনি বারদুই লন্ডনে এসেছিলেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। এক সপ্তাহান্তে আমার পরিবারের সাথে তাকেও নিয়ে আমরা পল্লী ইংল্যান্ডের শোভা দেখতে কয়েক শ’ মাইল গাড়িতে ঘুরেছি। ১৯৬৮ সালে তিনি বিবিসির পূর্ব পাকিস্তান সংবাদদাতা নিযুক্ত হন। স্বভাবতই প্রায়ই টেলিফোনে তার সাথে আমার কথাবার্তা হতো। তার কিছুকাল পর তিনি লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকারও খণ্ডকালীন সংবাদদাতা নিযুক্ত হন। এ পর্বে তার সাংবাদিক প্রতিভার সবচেয়ে উজ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেছে ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে।
পাকিস্তান সরকার প্রথমে এ প্রলয়ের ধ্বংসলীলাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের দূত হিসেবে চীন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ঢাকা হয়ে পিকিং যাচ্ছিলেন। কয়েক ঘণ্টা তিনি যাত্রা বিরতি করেন ঢাকায়। কিন্তু আকাশ থেকেও ঘূর্ণি প্রলয়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখে যাওয়ার কথা তার মনে হয়নি। তখন বলতে গেলে প্রায় সব রকমের যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মূসা তার প্রত্যুৎপন্নতা দেখিয়ে মনপুরা ও অন্যান্য চরে যান। ঢাকায় ফিরে টেলিফোনে তিনি আমাকে ভয়াবহতার কিছু বিবরণ বলেন। তার বিস্তারিত প্রতিবেদনেই প্রথম জানা গেল যে প্রায় পাঁচ লাখ লোক এবং অসংখ্য গবাদিপশু সে প্রলয়ে মারা গিয়েছিল। বিবিসির পরে সানডে টাইমস পত্রিকায় তার পূর্ণপৃষ্ঠা বিবরণ প্রকাশিত হয়। সেসব বিবরণে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
তার পরই তিনি সেই বছরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন। বিবিসির নিয়মানুযায়ী কোনো কর্মচারী দলীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন না। মূসা আপসে বিবিসি থেকে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান এমপি মূসাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক নিযুক্ত করেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন ঢাকা যাই, মূসা একদিন আমাকে বিটিভির প্রাভাতিক সম্পাদকীয় বৈঠকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। আরো পরে তিনি যখন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন তখন একবার ঢাকায় তার সাথে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ হয়েছিল। একজন অতি পুরনো বন্ধু ও সহকর্মীর অভাব আজ তীব্রভাবে অনুভব করছি।
(লন্ডন, ১০.০৪.১৪)
লেখক : বিবিসিখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক


Leave a comment...

You need to login before submit comment. | Check the box to save Password (Uncheck if on a shared computer)