এবিএম মুসাঃ সংকলন - ১

এবিএম মূসা: বৃত্তের ভেতরে ও বাইরে
মীযানুল করীম
১৩ এপ্রিল ২০১৪, রবিবার
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। ফেনী শহরে ডাক্তারপাড়ার পূর্ব প্রান্তে ‘তিতু মোক্তার’ সাহেবের বাসা। আর পাড়ার পশ্চিম প্রান্তে আমাদের বাসা। মোক্তার সাহেবের এক মেয়ে স্কুলে আমার বড়বোনের একই কাসের ছাত্রী। বড় ভাইবোনদের কাছে শুনি, তিতু মোক্তার সাহেবের ভাই অনেক বড় সাংবাদিক, তিনি অবজার্ভার সম্পাদক আবদুস সালাম, আর ছেলে (মোয়াজ্জেম হোসেন) বুলু সে পত্রিকার ফটোগ্রাফার। আরো জানলাম, সালাম সাহেবের ভাগ্নে ও জামাতা এবিএম মূসা অবজার্ভারের একটি বড় পদে আছেন।
আবদুস সালামের নাম ফেনীর গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সুপরিচিত ছিল। তার সম্পর্কে প্রচলিত কিছু কাহিনী তাকে ব্যতিক্রমী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে করে তুলেছিল কিংবদন্তিতুল্য। এমনকি তখন মূসা সাহেবের বয়স বেশি না হলেও তার ব্যাপারেও ‘মিথ’ চালু হয়ে গিয়েছিল। পরের কয়েক দশকে এবিএম মূসা প্রতিভা, কর্মকুশলতা ও অবদানের সুবাদে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের মতো মর্যাদা অর্জন করেছেন। তার ৬৪ বছরের কর্মজীবনসহ ৮৩ বছরের ইহজীবনের অবসান ঘটেছে ৯ এপ্রিল।
সাংবাদিক আতাউস সামাদের ভাষায়, ‘(প্রেসিডেন্ট) আইয়ুব খানের কালা-কানুন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের ডাকে আমরা রাজপথে মিছিল করেছিলাম। ইউনিয়নের নেতারা সম্পাদকদেরও রাজি করিয়েছিলেন ওই শোভাযাত্রায় যোগ দিতে। বৃদ্ধ মাওলানা আকরম খাঁও এসেছিলেন। তাকে মোটরগাড়িতে বসিয়ে শোভাযাত্রায় শামিল করা হয়েছিল। গাড়িটি ছিল মূসা ভাইয়ের ছোট্ট ছাদ-খোলা ঋরধঃ-৫০০ মডেলের নীল রঙের। ওটার হুড খুলে দেয়া হয়েছিল, যাতে মাওলানা আকরম খাঁকে দেখা যায়। মূসা ভাই নিজেই চালাচ্ছিলেন সেই গাড়ি।’
এবিএম মূসা বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে নোয়াখালী-১ (বর্তমানে ফেনী-১) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরশুরাম, ছাগলনাইয়া এবং স্বাধীনতার পর গঠিত ফুলগাজী থানা নিয়ে এই আসন গঠিত। ১৯৭৩ সালে এখানে মূসা সাহেব ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আবু বকর সিদ্দিক। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এই এলাকাতেও বিশেষত ছাত্র-তরুণদের মধ্যে জাসদ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। পরশুরামের সুবারবাজার হাইস্কুলের দীর্ঘ দিনের প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক ছিলেন জনপ্রিয়। তবে নির্বাচনের প্রাক্কালে ফেনী বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিশাল সমাবেশের প্রভাব, সাংবাদিক আবদুস সালামের ইমেজ এবং মূসা সাহেবের নিজের পরিচিতি মিলে সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবে তার বিজয় সম্ভব হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে একই এলাকা থেকে একই প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন অবজার্ভার সম্পাদক আবদুস সালাম। ‘৭৩ সালে যে জাসদ ছিল আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ, সেই জাসদের প্রার্থী (শিরীন আখতার) আওয়ামী লীগের জোট থেকে আওয়ামী প্রতীক নিয়ে ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা’য় এখন এই আসনের এমপি। কী বিচিত্র এ দেশ, সেলুকাস।

যা হোক, এবিএম মূসা এমপি হওয়ার পর একবার তার এলাকায় একটি ঘটনায় দুই ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। সাথে সাথে বিরোধী দল আন্দোলনে নেমে পড়ে। তখন কী কারণে বা কোন পরিস্থিতিতে লোক দু’টি মারা গিয়েছিল, তা এখন আর মনে পড়ছে না। মূসা সাহেব কিন্তু রাজনীতিতে নামতে চাননি। তার নেতা, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুই তাকে দলের প্রার্থী বানিয়েছিলেন। পরে তিনি লিখেছেন, সংসদ সদস্য হয়ে কখনো স্বস্তি বোধ করেননি। কারণ মনে হয়েছে, এটা তার ক্ষেত্র নয়। তার কাজের ক্ষেত্র সাংবাদিকতা।
এককালের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী লিখেছেন মানবজমিনে ‘বাকশালের বিরোধিতার প্রাক্কালে সংসদে আমার অকুতোভয় উচ্চারণকে তিনি (এবিএম মূসা) সুযোগ পেলেই দ্বিধাহীনচিত্তে উদ্ধৃত করতেন। এটা তার প্রতি আমাকে শুধু কৃতজ্ঞ ও বিমুগ্ধ করত না, সত্যের প্রতি সমর্থনে একটি বলিষ্ঠ প্রত্যয়বোধে আমার চেতনাকে শাণিত করত।’ বলা বাহুল্য, শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি অত্যন্ত স্বল্পসময়ে সংবিধানে বিরাট পরিবর্তন এনে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিল। এই অগণতান্ত্রিক সরকারপদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করে দলের যে দু-একজন নেতা মুখ খোলার সাহস দেখিয়েছিলেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী তাদের একজন। এবিএম মূসা, মুজিব ও বাকশাল প্রসঙ্গে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার মূল্যায়ন : পিতার সমালোচনা সন্তানদের মানায় না। তাই মুজিবের কোনো নিন্দা তার কাছে নেই। তবে একদল তথা বাকশাল যিনি করেছিলেন, তিনি (মুজিব) ছিলেন সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী, যার সমালোচনা তিনি করেন।
এবিএম মূসা বঙ্গবন্ধুর ভক্তই শুধু ছিলেন না, তিনি আওয়ামী মহলের সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রবীণতম। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের দু’চোখের বিষতুল্য ব্যক্তি হলেন প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এই সাবেক রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে মূসা সাহেবের মনোভাব কেমন ছিল? সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, এবিএম মূসা অকুণ্ঠচিত্তে বলতেন জিয়ার সমালোচনা তিনি কখনো করেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন, ‘জিয়া রাজনীতিক হিসেবে মন্দ ছিলেন, কিন্তু ছিলেন উত্তম প্রশাসক।’
রাষ্ট্রপতি জিয়া উদারতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের এবিএম মূসার বেলায়ও। তিনি ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে যোগ দিয়েছিলেন জাতিসঙ্ঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউনেপ) আঞ্চলিক পরিচালক (তথ্য) পদে। কোরিয়া থেকে ইরান পর্যন্ত প্রায় দুই ডজন দেশ ছিল তার কাজের আওতায়। বেতন দুই হাজার ডলার তখন বিরাট ব্যাপার। এ সময়ে একবার থাইল্যান্ড গেলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিস মূসা সাহেবকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জিয়ার সাথে। জিয়া তাকে বললেন, ‘দেশে চলে আসুন। দেশে আপনার মতো লোকদের দরকার।’
মূসা সাহেব একপর্যায়ে ব্যাংককের লোভনীয় চাকরিটি নবায়ন না করে ঢাকা ফিরে এলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সাথে প্রথম দেখা হলো দেশে ফেরার পর। ক’দিন পরই মূসা সাহেব নিযুক্ত হন প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) মহাপরিচালক, যে পদে ছিলেন একটানা চার বছর। আজকের যুগে পিআইবি কিংবা আর কোনো প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন আদর্শের এবং বিরোধী দলের সমর্থক কোনো ব্যক্তি বড় পদে নিয়োগ পাওয়ার স্বপ্নই শুধু দেখা সম্ভব।
স্মর্তব্য, পিআইবির প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ছিলেন কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালাম। তিনি মূসা সাহেবের মামা ও শ্বশুর। রাষ্ট্রপতি জিয়া পিআইবি প্রতিষ্ঠা করে সৈয়দ মুর্তজা আলীকে চেয়ারম্যান এবং সালাম সাহেবকে ডিজি পদে নিযুক্ত করেছিলেন। এর আগে, ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে আবদুস সালামের মতো প্রখ্যাত সাংবাদিকের অবমাননার পর তিনি বিদেশে চলে গিয়েছিলেন।

সাংবাদিক কামাল লোহানী পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে এবিএম মূসার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, রিপোর্টারদের কাছ থেকে কাজ আদায়ে তার জুড়ি ছিল না। তিনি তাদের নিয়মিত ব্রিফ করতেন এবং কিভাবে প্রতিবেদন লিখবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। তাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন এবং ভালো কাজের প্রশংসা করতেন।
এ দেশের পত্রিকাজগতে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সংবাদপত্রের চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। এর পেছনে মূসা সাহেবের অবদান বিরাট। জানা যায়, আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে ব্রিটেনের অক্সফোর্ডে গিয়েছিলেন (১৯৬১ সালে)। ফিরে এসে তার প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান পুরোপুরি প্রয়োগ করেছেন বিশেষ করে অবজার্ভারে। এটা একাধারে কয়েক দশক ছিল এ দেশের সেরা ইংরেজি পত্রিকা। আমাদের দেশের সংবাদপত্রে আধুনিক প্রযুক্তির কাণ্ডারি এবিএম মূসা রঙিন ছবির ব্যবহার শুরু করেন। পত্রিকার শিরোনামে আনেন বৈচিত্র্য। তিনি উদ্যোগী হয়ে তদানীন্তন পাকিস্তান অবজার্ভারে পূর্ণকালীন আলোকচিত্র সাংবাদিক নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। মরহুম মূসা সাহেবের ভাষায়, দেশে আমরাই প্রথম ডুপ্লেক্স লেটার প্রেস চালু করি। অফসেট রোটারি ও গজ অফসেট মেশিনও প্রথম নিয়ে আসে অবজার্ভার। আমাদের ছিল নিজস্ব ফটো স্টুডিও এবং ব্লক তৈরির ব্যবস্থা। ১৯৬৫ সালে আমরা প্রথম পৃষ্ঠায় রঙিন ছবি প্রকাশ করি।
এবিএম মূসা নিজে জানিয়েছেন, ‘আমাকে কমনওয়েলথ বৃত্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠানো হয়। সেখানে লন্ডন টাইমসসহ কয়েকটি বিশ্বমানের পত্রিকার সাথে আমি যুক্ত থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, পরে তা অবজার্ভারের মানোন্নয়নে কাজে লাগাই। শুধু ব্যানার হেডিংয়ের আকার ডাবল কলাম থেকে বাড়ানো কিংবা বড় করে ফটো ছাপানো নয়; উপমহাদেশের সংবাদপত্রের সবার আগে উৎসব বোনাস ও প্রণোদনা বোনাস চালুর কৃতিত্বও ঢাকার বিখ্যাত এই ইংরেজি দৈনিকের।’
এবিএম মূসা অতীতে বেশ কয়েকবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের। তখন কখনো বা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ‘৯০ সাল পার হওয়ার পর সাংবাদিক সমাজে রাজনৈতিক বিভাজন চরমে ওঠে এবং অনিবার্য পরিণাম হিসেবে সাংবাদিক ইউনিয়ন দুই ভাগ হয়ে যায়। মূসা সাহেবসহ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ঐক্য প্রয়াসে উদ্যোগী হয়ে সফল হতে পারেননি। এই প্রেক্ষাপটে একবার তিনি প্রেস ক্লাব নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হলেন। তাদের প্যানেলটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এর বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্যানেল। সেবার অবশ্য মূসা সাহেবসহ তার প্যানেল বেশির ভাগ আসনে পরাজিত হয়েছিল।
নির্বাচন উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে প্রার্থীরা গিয়ে ভোটারদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, প্যানেল মিটিংও হয়ে থাকে। সেবার মূসা সাহেব এক সন্ধ্যায় তার প্যানেলের লোকজন নিয়ে মগবাজারে দৈনিক সংগ্রাম অফিসে গেলেন। আমি তখন পত্রিকাটির সিনিয়র রিপোর্টার।
মূসা সাহেব বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, “আজ দৈনিক সংগ্রাম অফিসে এসেছি। আমরা সেই ছাত্রজীবনেই ‘সংগ্রাম’ পত্রিকাকে জানতাম, যা ছিল একটি সাপ্তাহিক। আজ নামের মিল দেখে অতীতের কথা মনে পড়ছে। ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে যে সংবাদপত্র সর্বপ্রথম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, সেটি ফেনীর সাপ্তাহিক সংগ্রাম।”
নিজে ফেনী শহরের মানুষ হয়েও ইতিহাসের এই তথ্য জানতাম না। সেই সাপ্তাহিক ‘সংগ্রাম’ বের করেছিলেন তখনকার বামপন্থী রাজনীতিক খাজা আহমদ (পরে আওয়ামী লীগের এমপি)।
যা হোক, সেদিন নিউজ রুমে মূসা সাহেব তার সাথীদের নিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন। ঘটনাক্রমে তিনি বসেছিলেন আমার টেবিলের সামনেই। আমার নাম-পরিচয়, জেলার খোঁজ নিলেন। বললাম, ‘বাড়ি ফেনীতে’। কৌতূহলী হয়ে যখন জানলেন আমার গ্রাম তাদের এলাকায়, তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের চন্দনা গ্রামেও গিয়েছি। সেখানে গিয়েছিলাম জাহাঙ্গীর খণ্ডলীর বাড়িতে। তোমার বাড়ি কি রেজাউল করিম-আতাউল করিমদের বাড়ি?’ বললাম, ‘জি, তারা আমার চাচাতো ভাই।’ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত এ এইচ এস আতাউল করিম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব রেজাউল করিমের কথাই বলছিলেন। আর যে জাহাঙ্গীরের কথা বললেন, তিনি ছিলেন স্থানীয় জননেতা এবং সেলিনা পারভীনের স্বামী; জাতীয় প্রেস ক্লাবে শহীদ সাংবাদিকদের তালিকায় যিনি একমাত্র মহিলা।
আমাদের দেশে এক সময় বামপন্থী আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে। এবিএম মূসা ছাত্রজীবনে শুধু সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন না, বামপন্থীদের মধ্যে খুব র্যা ডিকেল হিসেবে গণ্য, আরএসপি দলের কর্মীও ছিলেন। এই দলের পুরো নাম রেভ্যুলুশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি, যা এখনো ভারতে তৎপর। অতীতে এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবিএম মূসা, নির্মল সেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোজাম্মেল হক প্রমুখ। পরে তাদের সবাই সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মূসা সাহেব এক সময়ে একনিষ্ঠ মার্কসবাদী ছিলেন। তবে তিনি ধর্ম বিসর্জন দেননি; আশির দশকেই হজ করেছিলেন। প্রেস ক্লাবে আড্ডার মধ্যেও তিনি ছুটে এসে নামাজ পড়ে নিতেন। এ দৃশ্য দেখেছেন অনেকেই।
এবিএম মূসা নয়া দিগন্তেও লিখেছেন। একবার ঈদ সংখ্যায় লিখেছিলেন শৈশবে কলকাতায় ঈদ উদযাপন নিয়ে। বিখ্যাত গড়ের মাঠের বিশাল জামাতে ঈদের নামাজ পড়ার বিবরণ দিয়েছেন। সম্ভবত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বা বিখ্যাত এমন কেউ ইমামতি করেছিলেন।
শুক্রবার অফিস করলে কাছেই মতিঝিল ইডেন মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে থাকি। ২০০৫ সাল বোধ হয়। এক দিন জুমা শেষে নয়া দিগন্ত অফিসে ফেরার পথে দেখি, যুগান্তর সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা রাস্তার পাশে দোকানের সিঁড়িতে একা বসে আছেন। হঠাৎ দেখে চমকে উঠি। গরমের দিনে কান্তি দূর করতেই হয়তো জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি যে গণমানুষ থেকে দূরে থাকতে চাননি, এই ঘটনা সেটাই মনে করিয়ে দেয়।
আমাদের দেশে এখন সব পেশা এবং সমাজের প্রতিটি অঙ্গন দলীয় রাজনীতির কবলে পড়ে কলুষিত; এমনকি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। সাংবাদিক, লেখক ও শিল্পীসমেত বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে গত দুই দশকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক বৃত্ত বা বলয়ে বন্দী হয়ে গেছেন। রাজনীতি সক্রিয়ভাবে না করে বিশেষ কোনো আদর্শের সমর্থক, এমন সাংবাদিক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী আগেও ছিলেন। তবে এখন তাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ দলের গোঁড়া অনুসারীরা সংখ্যায় বিপুল। অতএব, তারা দেশের চেয়ে দল, দলের চেয়ে নেতা বা নেত্রীকে বড় মনে করেন। বাংলাদেশে রাতকানা রোগের প্রকোপ অনেক কমেছে; কিন্তু ‘দলকানা রোগ’ বেড়ে গেছে অনেক। দৈহিক ব্যাধি সারানো সহজ, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তির ব্যারাম তাড়ানো ঢের কঠিন। এবিএম মূসার স্বাতন্ত্র্য ও সাফল্য হলো, তিনি দলীয় রাজনীতির সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত ভক্ত হয়েও বর্তমান আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেশের বহু লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্টের মতো তিনি নিজের স্বাধীন বিচার-বিবেচনা, বিবেক ও নীতিবোধকে রাজনীতির বিভ্রান্ত বলয়ের মধ্যে সীমিত করে ফেলেননি। এই স্বাধীনচেতা ও সাহসী মনোভাব অনেকেরই পছন্দ হয়নি। জনগণ লক্ষ করেছে, আজীবন আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকা পালন করলেও সে দলের সরকারপ্রধান তার লাশ দেখতে যাননি; সংসদ প্লাজায় জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি।
গভীর রাতে টিভির টকশোতে মরহুম এবিএম মূসা বলতেন, সাংবাদিক সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার কাছে বহু তথ্য রয়েছে এবং হয়তো তার মৃত্যুর পর সেগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হবে। অপর দিকে গত বছরের শেষ প্রান্তে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আগ্রহে মূসা সাহেবকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলার জন্য তার কাছে এসেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সে মোতাবেক মূসা সাহেব রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বিএনপি নেতৃত্বকে রাজি করান। এরপর বেগম জিয়া গেলেন বঙ্গভবনে। তবে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হয়নি বড় দুই দলের। এ প্রসঙ্গে মূসা সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন দৈনিক মানবজমিন- এর প্রধান স¤পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী লিখেছেন “যেভাবে জাতিসঙ্ঘ দূত ফার্নান্দেজ তারানকোর দূতিয়ালি ব্যর্থ হয়েছিল, রাষ্ট্রপতির উদ্যোগও সেভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। মূসা ভাই আমাকে অফিসে এসে এ ঘটনা বলেছিলেন। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘খবরদার’ এটা কাউকে বলবি না।”
মূসা সাহেবের নামের শুরুতে ‘এবিএম’। এর অর্থ যে ‘আবুল বাশার মোহাম্মদ’, তা তার মৃত্যুর আগে আমরা জানতাম না। এখন সেটা জানতে পেরেছি। সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির মৃত্যুরহস্য কিংবা সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়া সম্পর্কে তিনি যা জানতেন, তা কি এখন আমরা জানতে পারব?


Leave a comment...

You need to login before submit comment. | Check the box to save Password (Uncheck if on a shared computer)