১৯৭৪ সালের দিল্লি চুক্তির অজানা অধ্যায়

সর্বোপরি, পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল, যখন জাতীয় অর্থাৎ পাকিস্তানি দল গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে খেলোয়াড় বাছাইয়ে এসব অবাঙালি খেলোয়াড় প্রাধান্য পেতে থাকলেন। সবাই বাঙালি খেলোয়াড়দের বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে শোরগোল করে উঠলেন। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে ভিক্টোরিয়া দল মাঠে নামলেই দর্শকেরা ‘দুয়ো-দুয়ো’ করে উঠতে থাকেন, নানা রকম টিটকারি দিতে থাকেন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের। শেষ পর্যন্ত ঢাকার ফুটবল টিমে পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সংখ্যা পাঁচজনের বেশি হতে পারবে না বলে সীমা নির্ধারিত হলো। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড় আমদানি করে ভিক্টোরিয়া সেই যে দর্শকদের বদনজরে পড়ল, তাতে ক্লাবটি একসময় খেলার জগতের প্রথম সারি থেকে হারিয়ে গেল।
খেলোয়াড়, দর্শক, ক্রীড়ামোদী ও ক্রীড়ানুরাগীদের মধ্যে যখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মনোভাব গড়ে উঠছিল, একই সঙ্গে ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যেও একটি বিশেষ ধারা কাজ করছিল। সেই ধারা গড়ে উঠেছিল ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ ও সামগ্রিকভাবে ক্রীড়া সংগঠনে বিদ্যমান বৈষম্যকে কেন্দ্র করে।
তখন খেলাধুলার জন্য অর্থ বরাদ্দ ও ক্রীড়াজগতে কর্তৃত্ব পুরোপুরি ছিল যথাক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি সংগঠকদের হাতে। কেন্দ্রীয় বাজেটে খেলাধুলার জন্য বরাদ্দের সামান্য মাত্র অর্থ আসত পূর্ব পাকিস্তানে। এই অর্থ সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ছিল প্রায় এক কোটির মতো, এখনকার হিসাবে ১০০ কোটি বলা যেতে পারে। তা থেকে পূর্ব পাকিস্তান পেত সাকল্যে মাত্র এক লাখ টাকা, অর্থাৎ বর্তমান হিসাবে কোটি খানেক। এই বরাদ্দ দেওয়া হতো পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনকে, যা ফেডারেশন ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস ও অন্যান্য ক্রীড়া সংগঠনের মধ্যে বণ্টন করত। এসব সংগঠন আবার আলাদা ছিল না, ফেডারেশনেরই বিভিন্ন শাখা ছিল, যাকে ‘সেকশন’ বলা হতো। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া বরাদ্দ ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিটি খেলার জন্য ছিল আলাদা ফেডারেশন ও স্বাভাবিকভাবেই আলাদা বরাদ্দ।
এসব বরাদ্দের ভাগ পেত না পূর্ব পাকিস্তান, সব টাকাই পশ্চিমে খরচ করা হতো। এই বৈষম্য একসময় এখানকার ক্রীড়া সংগঠকদের নজরে আসে, তাঁদের মধ্যে প্রথমে গুঞ্জন, পরে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের কর্মকর্তারা এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করতেন না। ফলে, ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যেও একটি বিদ্রোহী গ্রুপের জন্ম হয়। তারাই এগিয়ে এল ক্রীড়াক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।

এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।