দেশ ও দেশপ্রেম :

সস্তা কথনের ডামাঢোলে চাপা পড়া গভীর মানবিক অনুভূমায়ের প্রতি আপনার অনুভূতি কি? অনুভূতি কি আপনার শৈশব ও কৈশোরের পাঠশালাটির প্রতি? কিংবা যে গ্রামটিতে আপনার জন্ম সেটার ব্যাপারে?
একটা সাধাসিধে উত্তর সবার জানা থাকলেও এ অনুভুতি পুরোপুরি না বোধগম্য, না প্রকাশযোগ্য! যার মা আর নেই, যিনি গাঁ ত্যাগ করে দুরে যাননি, যিনি ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভিন দেশের মাটিতে পা দেননি- তার পক্ষে এ অনুভুতি পুরোপুরি আত্নস্থ করা প্রায় অসম্ভব। তবে এটুকু বলা সম্ভব- আস্ত পাগলের মাঝেও আমি স্বগ্রাম, স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি টান দেখেছি। মানুষ কেন, অবোলা গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, কবুতর, হাঁস, মুরগী, চড়ুই পাখির মাঝেও দেখেছি বসতভিটা, গৃহস্থ বা গ্রামের নিজস্ব পরিমন্ডলের প্রতি অগাদ টান। বস্তুত: মানুষ ও সকল প্রাণিরই এটা একটা বেসিক ইনস্টিংক্ট বলা চলে। দেশপ্রেম মানুষের মজ্জাগত।
দুরের কোন দেশে অচেনা মানুষ ‘বাঙ্গালী’ চেহারার মনে হলেই ইনিয়ে বিনিয়ে কথা পাড়ি। বাংলাদেশী হলে সাথে সাথে দেশী ভাই। কথার ফাঁকে জেলাটা মিলে নোয়াখালী, বরিশাল, সিলেট ইত্যাদি হয়ে গেলেতো আরেক কাঠি সরেস! হাজারো ভিন দেশী পতাকার মাঝে লাল সবুজ পতাকা দেখলে ঘোরতর ‘সন্ত্রাসীর’ ও মনটা আহা! উহু! করে উঠে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোন রাস্তায় হঠাৎ আবদুল আলীমের গান কানে বেজে উঠলে, কসম করে বলতে পরি আস্ত কসাই কোন বাংলাদেশীর পক্ষেও কান পাতা থেকে বিরত থাকা কঠিন হবে! অস্ট্রেলিয়ার কোন সুপারমার্কেটে জামা কিনতে গিয়ে কেউ মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ দেখে খুশী না হয়ে পারেননা।
এ অনুভুতি বাংলাদেশ মাত্রিক নয়। এটা সার্বজনীন। নেপালী, ভুটানী, সিংহলী, চাইনিজ, মিশরী, মেক্সিকান সবাই এ রকম। মা, মাতৃভাষা, মাতৃদেশ, মাতৃগ্রাম, মাতৃধর্ম, মাতৃসংস্কৃতির প্রতি মানুষের টান অবিনশ্বর।
যুগে যুগে স্বৈরাচারী/স্বৈরাচারিণী শাসকগন নাগরিকগণের অবিনশ্বর, প্রাকৃতিক ও মজ্জাগত এ অনুভুতির ‘সত্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বড়াই করে ঢোল পিটিয়ে বলেছে তারাই বড় দেশপ্রেমিক এবং যেসব অপকর্ম তারা করছে তাও ‘দেশের স্বার্থে।’ প্রতিপক্ষকে ‘ভিন দেশের দালাল’ বলে আখ্যা দিয়ে যারপরনাই হেনস্থা করেছে। এখনো করছে। সামনেও করবে! চরিত্ররা পাল্টাবে হয়তো।
আমি বলব- চরম স্বৈরাচারী সেসব শাসক কিংবা ‘দেশ প্রেমহীন ভিনদেশের দালাল বিরোধীরাও’ নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। আয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ভারতের দালাল মনে করতেন। অথচ বাস্তবতা: এই যে তারা উভয়েই যথেস্ট পাকিস্তান প্রেমিক ছিলেন!
পরিস্কার করে বলতে গেলে চোর, গুন্ডা, ডাকাত, হুজুর, ডাক্তার, ছাত্র, গার্মেন্টস শ্রমিক, শিল্পপতি, সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সহ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ও আদমশুমারীর খাতায় না থাকারা সবাই নিখাদ দেশপ্রেমিক।
তবে ক্ষমতার লিপ্সা, টাকার লোভ, পদের লালসা, ভিন্নমতের কাছে হেরে না যাবার বাসনায় ‘দেশপ্রমিকরা’ এমন অনেক কাজ করেন যা নিন্দনীয়। কিন্তু এর অর্থ এই না যে তাদের উপরে উল্লেখিত দেশপ্রেমবোধ উবে গেছে। এমনকি পেইড এজেন্টরাও মনে মনে নিজ দেশের টান ছাড়তে পারেননা!
চরম নিন্দার একটি বিষয় হল, দেশপ্রেম সস্তাকরণ মচ্ছব। নানাবিধ গান, কবিতা, ছড়া, দেয়ালিকা, বক্তৃতা, কুচকাওয়াজ দিয়ে গোস্টিগত ভাবে বাঙ্গালী (ও আরো কিছু জাতি) দেশপ্রেম জাহির করে থাকে। বাংলাদেশের গুনগান নিয়ে যতশত গান, কবিতা, কুচকাওয়াজ হয় বা হচ্ছে হলফ করে বলা যায় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদিআরব, উগান্ডা, ব্রাজিল, বেলারুশ বাসীরা এর ধারে কাছেও নেই! এমনকি নেই নিকটের বার্মা ও ভারতীয়রাও! অথচ অন্তরে তারা তাদের দেশকে আমাদের চেয়ে কোন অংশে কম ভালবাসেনা। আর কর্মেতো শত কদম এগিয়ে।
তবে বাঙ্গালীর স্বদেশটানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিনা। প্রশ্ন তুলছি হাল ফ্যাশনের জাহিরি প্রবনতা নিয়ে। সস্তা কথনের ডামাডোল নিয়ে।
এক গভীর সত্য মানবিক অনুভূতিকে খেলো না করলেই কি নয়?

palalikman /৭ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৫৮


Leave a comment...

You need to login before submit comment. | Check the box to save Password (Uncheck if on a shared computer)