বাংলার স্থাপত্যে নতুনত্ব

রফিক আজম
স্থাপত্যে বাংলার মুখ
দোতলায় উঠোন কিংবা তিনতলায় পুকুর নির্মাণ করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি রফিক আজম। ২০১২ সালে তিনি পেয়েছেন লিডিং ইউরোপিয়ান আর্কিটেক্ট পুরস্কার।

গুলশানের বাসাটার গেট দিয়ে ঢুকতেই বেশ ধাক্কামতো খেলাম। ঘাসের ওপর দুইটা শালিক। নিজেদের ভাষায় খুব ঝগড়া করছে। ঢাকা শহরে জীবনানন্দের হলুদ ঠ্যাংয়ের এমন শালিক দেখতে পাব ভাবিনি। ধুপ করে একটা শব্দ হলো। ভয়ে শালিক দুটো উড়ে গেল। আর আমি দৌড় লাগালাম। গাছ থেকে একটা কাঁচা আম পড়েছে। না দৌড়ে কি আর পাড়া যায়। আমার দৌড় দেখে স্থপতি রফিক আজম হেসে ফেললেন, গ্রামে যারা বড় হয়েছে তারা আম পড়লে দৌড় দেবে না, এটা ঠেকানো খুব মুশকিল। চলেন বাড়িটা ঘুরে দেখাই, আপনি আপনার গ্রামের অনেক কিছুই খুঁজে পাবেন এখানে। তারপর তিন ঘন্টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনি দেখালেন তাঁর নকশা করা বাড়িঘর। শুধুই অবাক হওয়ার পালা।
দোতলায় উঠোন কিংবা তিনতলায় পুকুর নির্মাণ করে বিশ্ববাসীকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি রফিক আজম। স্থাপত্যশিল্পে এ বছর (২০১২) অত্যন্ত সম্মানজনক ‘লিডিং ইউরোপিয়ান আর্কিটেক্ট ফোরাম’ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। নয় বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্থপতিদের দেওয়া হচ্ছে এটি। ‘ডেনিয়েল লেভিস্কি’র মতো নামকরা স্থপতিকে না দিয়ে পুরস্কারটি যখন রফিককে দেওয়া হলো, সেই লেভিস্কি উঠে এসে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন, রফিকের কাজের একজন বড় ভক্ত তিনি। বর্তমান বিশ্বে রফিকের কাজ ব্যাপক আলোচিত। তাঁর কাজের ব্যতিক্রমী ধারা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে দেশে দেশে।
রফিক আজমের জন্ম পুরান ঢাকার লালবাগে, ১৯৬৩ সালে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। ছোটবেলায় দেখেছেন বোনেরা গান করছে, ভাইয়েরা ছবি আঁকছে, আম্মা বাগান করছেন। বাড়ির উঠোনে পরিবারের সবাই মিলে গল্পের আসর বসিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছেলে হবে ইঞ্জিনিয়ার। তাই তিনি ভর্তি হন বুয়েটে। ফলে, রফিক নিজেকে বলেন ‘ঘটনাচক্রে স্থপতি’। রফিক বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁকে কিছু মাপজোক আর হিসাবনিকাশ শিখিয়েছে। রফিকের মূল শিক্ষাটা হয়েছে তাঁর মায়ের কাছ থেকে, পরিবার এবং পারিপার্শ্ব থেকে। তাই প্রথাগত স্থাপত্য নির্মাণ করেন না তিনি। বসতবাড়ি থেকে সীমানাপ্রাচীর উঠিয়ে দিয়েছেন, রেখেছেন বসার জায়গা কিংবা নিচু দেয়াল। যেন বাড়ির সঙ্গে পথচলতি মানুষের সম্পর্কটা হয় বন্ধুত্বের। দৃশ্যমান কোনো বিরোধ যেন না থাকে বাড়ি আর পথিকের মধ্যে।
রফিকের কাজে আলো ও রোদের খেলা, সবুজের সমারোহ, ফাঁকা জায়গা এবং জলের নন্দন প্রাধান্য পায়। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর ভবন। সূর্যের সামান্য হেলে পড়া কিংবা দক্ষিণের বাতাস সবই তিনি পেতে চান গৃহে। রফিকের নির্মিত ভবনের ভেতর ঢুকলেই মনে হবে এটি শুধু ভেতর নয়, বরং বাইরের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের আবহমান গ্রামীণ বাড়িগুলো মাটিলগ্ন, সামনে একটা উঠোন, আশপাশে কোথাও ছোট পুকুর। এই নকশাটাকেই রফিক আনতে চেয়েছেন তাঁর নির্মিত ভবনগুলোতে। কেননা তিনি জানেন, মানুষ আসলে প্রকৃতির মধ্যেই থাকতে চায়। না হলে ছুটি পেলে সবাই গ্রামে যেতে চায় কেন? আধুনিক খুপরি ফ্ল্যাটগুলোতে যে রকম একটা বদ্ধ ভাব থাকে, রফিকের ভবনগুলোতে তা নেই। কিছুটা আকাশ যেন ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। সবুজের ফাঁকা দিয়ে এক চিলতে রোদ খেলা করে। বাংলাদেশের প্রকৃতি হলো রফিকের কাজের মূল প্রেরণা। বহু বর্ণে চিত্রিত এই প্রকৃতি, এক এক ঋতুতে এক একটি বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
স্থাপত্যে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন রফিক। ‘ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচার কমিউনিটি পুরস্কার’, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কেনেথ এফ ব্রাউন এশিয়া প্যাসিফিক কালচার অ্যান্ড আর্কিটেকচার ডিজাইন’ পুরস্কার, ২০০৭ সালে সারা বিশ্বের তরুণ স্থপতিদের জন্য সেরা পুরস্কার ‘এ আর অ্যাওয়ার্ড ফর ইমার্জিং আর্কিটেক্টস’, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৫ এবং ২০১১ সালের ‘সাউথ এশিয়া আর্কিটেকচার কমেন্ডেশন’ পুরস্কার। সর্বশেষ পেলেন ‘লিডিং ইউরোপিয়ান আর্কিটেক্ট ফোরাম’ পুরস্কার। স্থাপত্যবিষয়ক সারা বিশ্বের নানা সেমিনারে রফিক মূল বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বিগত ১২ বছর রফিক সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়াচ্ছেন।
স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তান আরাফকে নিয়ে রফিক আজমের সংসার। স্ত্রী ড. আফরোজা আক্তার কাজ করছেন জাতিসংঘে আর ছেলে আরাফ ইংরেজি মাধ্যমে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে।
রফিকের প্রথম কাজ লালবাগে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। বুয়েটে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় নিজেদের বাড়ির ডিজাইন করেন তিনি। প্রথমে পুরোনো বাড়িটি ভেঙে নতুন বাড়ির ডিজাইন করতে দেওয়া হয় অন্য একজন স্থপতিকে। কিন্তু তাঁর ডিজাইন পছন্দ হয়নি রফিকের মায়ের। মায়ের কথা ভেবেই রফিক নকশা করেন তাঁদের নতুন বাড়ির। বাড়ি হতে হবে দোতলা। এক চিলতে উঠোন আর প্রিয় বাগান রফিক ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন মাকে। ফলে দোতলায় নির্মাণ করেছেন বাগান, বসার জায়গা। ১৯৮৭ সালে নির্মিত এই বাড়িটাই বাংলাদেশের প্রথম বাড়ি, যার দোতলায় বাগান আছে।
রফিক যে সবুজের চর্চা করেন তার জন্য শৌখিন নার্সারির কাছে যেতে হয় না। যেকোনো সাধারণ উদ্ভিদ সাবলীল বেড়ে উঠতে পারে তাঁর নির্মিত ভবনের আশ্রয়ে। গুলশানের যে ভবনটির জন্য ‘লিডিং ইউরোপিয়ান আর্কিটেক্ট ফোরাম’ পুরস্কার পেলেন, সেটির বিশিষ্টতা জানতে চাওয়া হলে রফিক বলেন, ‘আমি আসলে একটা সম্ভাবনাময় শূন্যস্থান বানাতে চেয়েছি। কিন্তু শূন্যকে বোঝাতে গেলে আশপাশে কিছু পূর্ণতা দরকার হয়, ভবনের অন্য সবকিছুই সেই উদ্দেশ্যে নির্মিত।’ ওই ভবনের ফাঁকা জায়গাটাই মুখ্য অংশ। পুরো ভবনের জন্য সেটি একটি আশ্রয়। ফাঁকা জায়গাটি একই সঙ্গে পুকুর ও বাগান। পুকুরে শোভা পাচ্ছে ছোট্ট একটি নৌকা। রফিক মনে করেন, একটি ভবনকে যদি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে প্রকৃতি হলো তার আত্মা। দেহের সঙ্গে আত্মার সংযোগ না থাকলে সেটা মৃতদেহ।
বুয়েট শেষ করে স্থাপত্যিক নামের একটি নির্মাণ ফার্মে যোগ দেন রফিক। এরপর ১৯৯৫ সালে শুরু করেন সাতত্য নামের নিজের প্রতিষ্ঠান। সাতত্য মানে রফিক বললেন, প্রবহমানতা। প্রকৃতি এবং মানুষের বাসস্থলের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের কাজ করে সাতত্য।
শিক্ষক হিসেবে রফিককে ব্যাপক প্রভাবিত করেছেন গ্লেন মার্কট। অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করার সময় রফিক তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। স্থাপত্যে পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারই দেওয়া হয়েছে সুফির মতো এই মানুষটাকে। গ্লেন মার্কট মনে করেন মাটি হলো মা, সেখানে কিছু করতে চাইলে খুব খেয়াল করতে হবে যে তাকে যেন আঘাত করা না হয়। রফিক তাঁর শিক্ষকের মতোই মনে করেন মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতায় ভালো স্থাপত্য নির্মিত হতে পারে না। পারস্পরিক সখ্য এবং সমঝোতার মাধ্যমেই কেবল নান্দনিক নির্মাণের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব।

 

 


Leave a comment...

You need to login before submit comment. | Check the box to save Password (Uncheck if on a shared computer)